রথযাত্রা, ভারতের
উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী হল এর পিঠস্থান। আষাঢ়ের শুক্লা দ্বাদশীর দিন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান।
এই উৎসবের নামই হল রথযাত্রা। সাতদিন সেখানে কাটিয়ে আবার তাঁরা ঘরে ফেরেন। বাংলার
রথযাত্রার ইতিহাস প্রাচীন। বহুযুগ আগে থেকেই জগন্নাথকে কেন্দ্র করে এমন সাংস্কৃতিক
উৎসব হয়ে আসছে বাংলায়। আর শ্রীচৈতন্যের সময়ে এই রথযাত্রা উৎসবের সঙ্গে বাঙালির
যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়েছে।
রথযাত্রা উপলক্ষে বিপুল জনসমাগম হয় শ্রীক্ষেত্র
পুরীতে। যদিও পুরীর মন্দিরে, প্রতিদিনই
জগন্নাথদেবকে ছাপ্পান্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। তবু রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করা
হয় এ-সময়ে। ভোগ রান্নার পুরো আয়োজনটাই হয় মন্দিরের বিরাট হেঁশেলে। এই হেঁশেলকে
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রান্নাঘরও বলা হয়ে থাকে।
কথিত আছে, পুরীর
জগন্নাথ মন্দিরের মহাপ্রসাদের এমনই মহিমা যে, কোনও
দিন সেখানে প্রসাদ বাড়তিও হয় না, আবার
কমতিও পড়ে না। অর্থাৎ কারো সেখানে প্রসাদ না পেয়ে ফিরতে হয় না। পুরীর জগন্নাথের
মন্দিরে ব্যবহৃত হয় না কোনও প্রকারের ধাতব বাসনপত্র। এই মন্দিরে কোন বৈদ্যুতিক
যন্ত্রপাতিও নেই।
মহাপ্রসাদের পুরো রান্নাটাই করা হয় মাটির
পাত্রে। এখানে কোনও পুরনো পাত্রে রান্না করা হয় না, প্রতিদিন
নতুন পাত্রেই রান্না করা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি পাত্র রান্নার জন্য একবারই ব্যবহৃত
হয়। একদল খালি মাটি দিয়ে পাত্র বানায়, আর
একদল তা সরবরাহ করে রান্নাঘরে।
পুরীর জগন্নাথের এই মন্দিরের পিছনে একটি বিরাট
হেঁশেলে বছরের ৩৬৫দিন তৈরী হয় ভোগ। একে রোসাঘর বলে। মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে
রোসাঘরের অবস্থান। রোসাঘরে রয়েছে ৭৫২টি উনুন। হেঁশেলে ভোগ তৈরির কাজ করেন প্রায়
৬০০ জন রাঁধুনি ও তাঁদের সাহায্যের জন্য থাকেন প্রায় ৪০০ জন সেবক। রোসাঘরটি প্রায়
১৫০ ফুট লম্বা, ১০০ ফুট
চওড়া। হেঁশেলের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। হেঁশেলের মধ্যে প্রায় ৩২টি কক্ষ রয়েছে।
এখানে রান্নার পদ্ধতিটিও বেশ অভিনব। প্রতিটি উনুনের রয়েছে একটি করে বড় মুখ। তার
চারপাশে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মুখ থাকে। উনুনের মুখে সবচেয়ে বড় মাটির
হাঁড়িতে অন্ন বসানো হয়। তার উপরে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত ক্রমশ ছোট হতে থাকা হাঁড়িতে নানা
ধরনের তরকারি, পায়েস
রান্না হয়।
একেবারে নীচের পাত্র থেকে ওঠা বাষ্পের ভাপে
রান্না হয় উপরের পাত্রগুলিতে থাকা শাকসব্জি, অন্ন
এবং মিষ্টান্ন । রান্নার সময়ে অন্ন কিংবা শাকসব্জিতে কোনও ভাবেই হাত দেওয়া হয় না
বা নাড়াচাড়া করা হয় না। প্রত্যেকটি পাত্রে আলাদা আলাদা ভোগ রান্না করা হয়।
বিস্ময়কর ভাবে সবার আগে সবচেয়ে উপরে থাকা পাত্রটির রান্না শেষ হয়। তার পরে রান্না
শেষ হয় তার ঠিক নীচে থাকা পাত্রটির। এ ভাবে সব শেষে সুসিদ্ধ হয় উনুনের উপরে রাখা
শেষ হাঁড়ির ভোগ।
মাটির হাঁড়ির মধ্যে মূলত ফুটন্ত জলে সব্জি এবং
মশলা দিয়ে চলতে থাকে মহাপ্রভুর রান্না। চিনি নয়, রান্নায়
ব্যবহার করা হয় গুড়। এ ছাড়া, কোনও
রকম গুঁড়ো মশলা নয়, বাটা
মশলার ব্যবহার হয়। মশলার মধ্যে মূলত থাকে এলাচ, বড়
এলাচ, দারচিনি, গোলমরিচ, আদা, কালো সর্ষে, জোয়ান, লবঙ্গ, জায়ফল, হলুদ, নুন।কোনও
ধরনের বিদেশি সব্জি ব্যবহার করা হয় না। পেঁপে, আলু, টম্যাটো, কাঁচা
লঙ্কা জাতীয় কোনও রকম আনাজ প্রসাদ রান্নায় ব্যবহারের চল নেই। মূলত দেশীয় সব্জি, যেমন রাঙাআলু, পটল, ঝিঙে, কাঁচকলা, কাঁকরোল ইত্যাদি থাকে।
জগন্নাথ, বলরাম
আর সুভদ্রার জন্য রোজ ৫৬টি পদ রান্না করা হয় রোসাঘরে। এই পদগুলিকে মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়- ‘পাক্কা’ এবং ‘সুক্কা’। ‘পাক্কা’ বলা হয় সেই খাবারগুলিকে, যেগুলি সেদ্ধ করা হয়। যেমন
ডাল, চাল, খিচুড়ি এবং সব রকমের সব্জি।
অন্য দিকে, ‘সুক্কা’ বলা হয় গজা, মিষ্টি আর বিভিন্ন ধরনের
পিঠেকে।
রন্ধনশালার চত্বরে দু’টি কুয়ো আছে, যাদের
নাম গঙ্গা ও যমুনা। কুয়াগুলির ব্যাস ১০ ফুট, গভীরতা
প্রায় ১০০ ফুট। এই কুয়ো দু’টির
জল ব্যবহার করেই ভোগ রান্নার কাজ করা হয়। হেঁশেলের রাঁধুনিরা বংশপরম্পরায় এই কাজ করে
আসছেন। হেঁশেলে রান্না শুরুর আগে রাঁধুনিদের খাবার খেয়ে নিতে হয়। তার পর পান খেয়ে, স্নান সেরে, ভিজে
গামছা পরে, হেঁশেলের
পুজো করে শুরু হয় রান্নার প্রস্তুতি।
মূল রান্নাঘরের ভিতর সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ
হলেও বর্তমানে হেঁশেলের চারপাশটা ঘুরে দেখার সুযোগ পান ভক্তেরা। তার জন্য ভক্তদের
আলাদা করে টিকিট কাটতে হয়। মন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণে আছে আনন্দবাজার।
জগন্নাথদেবের রান্নাঘরে রান্না হওয়া প্রসাদ ভোগ মণ্ডপ থেকে চলে আসে আনন্দবাজারে।
দিনে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রসাদ বিক্রি হয় সেখান থেকে।
যুগ বদলায়, মানুষ
মারা যায়, পাল্টে
যায় জগন্নাথদেবের মন্দিরের রাঁধুনিরাও। কেবল পাল্টায় না শুধু জগন্নাথ মন্দিরের
রন্ধনশালায় তৈরি হওয়া ভোগের স্বর্গীয় স্বাদ। কীভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রসাদের
স্বাদ এক থাকে, তা অবাক
করে ভক্তদের।