ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়
ভারতীয় দর্শনের নয়টি শাখা বা সম্প্রদায় আছে। সম্প্রদায়গুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি নাস্তিক সম্প্রদায়, অপরটি আস্তিক সম্প্রদায়। চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ- এই তিনটি শাখা নাস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত। ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত- এই ছয়টি আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত। নাস্তিকরা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। আর আস্তিকরা বেদকে প্রমাণ্য গ্রন্থ বলে মনে করেন। তাহলেও নাস্তিক চার্বাক দর্শনের সঙ্গে নাস্তিক বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের বিস্তর পার্থক্য
রয়েছে।
চার্বাক দর্শনে কঠোরভাবে বেদের বিরোধিতা করা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে কঠোরভাবে বেদের বিরোধিতা করা হয়নি। বেদের বিরোধিতা করাই চার্বাক দর্শনের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বেদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের উদ্দেশ্য নয়।
চার্বাকরা প্রত্যক্ষ প্রামাণ্যবাদী। এই মতে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা জ্ঞানের একমাত্র উৎস। সেজন্য প্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের মধ্যেই তাঁদের দার্শনিক চিন্তা সীমাবদ্ধ। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনে অনুমানকে প্রমান বলে স্বীকার করা হয়েছে। এইজন্য দর্শন দুটিতে অনুমান বা যুক্তির ভিত্তিতে অপ্রত্যক্ষ বা অতীন্দ্রিয় নানা বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।
চার্বাক সম্প্রদায় জড়বাদী এবং নিত্য আত্মায় বিশ্বাসী নন। তাঁরা চৈতন্য বিশিষ্ট দেহকেই আত্মা বলেছেন। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় জড়বাদী নন। এই দুটি দর্শন বেদ বিমুখ হলেও আধ্যাত্মবাদী দর্শন। বৌদ্ধ দর্শনের যোগাচার শাখা বিজ্ঞান বা চেতনাকে একমাত্র তত্ত্ব বলেছে। জৈন দর্শনে আত্মা স্বীকার করা হয়েছে। জৈনমতে আত্মা হল দেহ থেকে ভিন্ন একটি স্থায়ী পদার্থ এবং চৈতন্য হল আত্মার স্বরূপগত ধর্ম। এছাড়া বৌদ্ধ দর্শনেও আত্মা স্বীকার করা হয়েছে, তবে তাঁরা আত্মাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই মতে নিত্য আত্মা নেই। আত্মা হল পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থার ধারা।
চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ- এই তিনটি দর্শনই নিরীশ্বরবাদী। এদের কোনটিতেই জগৎস্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বর স্বীকৃত নন।কিন্তু চার্বাকরা যে অর্থে নিরীশ্বরবাদী, জৈন ও বৌদ্ধরা সেই অর্থে নিরীশ্বরবাদী নন। কারণ বৌদ্ধদর্শনে বুদ্ধদেবের উপর এবং জৈন দর্শনে মুক্ত, পূর্ণ সিদ্ধপুরুষদের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে।
চার্বাক দর্শনে ধর্ম স্বীকৃত নয়। এখানে ধর্ম মানেই জীবের দেহধর্ম। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের ভিত্তি হিসাবে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম রয়েছে। ফলে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও অনুশাসনের প্রসঙ্গ এই দুটি দর্শনে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনকে সম্পূর্ণভাবে নাস্তিক্যবাদ বলা যায় না, যে অর্থে চার্বাকদের নাস্তিক বলা হয়।
আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত ছয়টি সম্প্রদায়-এর মধ্যে ন্যায় দর্শন, বৈশেষিক দর্শন, যোগ দর্শন হল ঈশ্বরে বিশ্বাসী আর সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন, বেদান্ত
দর্শন এরা হল ঈশ্বরে অবিশ্বাসী।
ন্যায় দর্শন:-
ন্যায় দর্শন হল সর্বশাস্ত্র-প্রদীপস্বরূপ। গৌতমমুনি বা অক্ষপাদ এই দর্শনের সূত্রকার। প্রধানত প্রমা ও প্রমাণের আলোচনাকে কেন্দ্র করে ন্যায় দর্শন বিস্তার লাভ করেছে। এজন্য এই দর্শনকে আন্বীক্ষিকী বলা হয়। ন্যায় দর্শনে চারটি প্রমাণ স্বীকৃত। এই চারটি প্রমাণ হল প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। ন্যায় দর্শন বস্তুবাদী দর্শন।
বৈশেষিক দর্শন :-
মহর্ষি কণাদ বৈশেষিক দর্শনের সূত্রকার। তিনি 'উলুক' নামেও পরিচিত। এই জন্য এই দর্শনকে 'ঔলুক্য দর্শন'ও বলা হয়। এই সূত্রের কোন প্রকৃত ভাষ্যগ্রন্থ পাওয়া যায় না। প্রসস্তপাদাচার্যের পদার্থধর্মসংগ্রহ বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্যস্থানীয় গ্রন্থ। বৈশেষিক সম্প্রদায় দুটি প্রমাণ স্বীকার করেন- প্রত্যক্ষ ও অনুমান। এছাড়া বৈশেষিক সম্প্রদায় সাতটি পদার্থ স্বীকার করেছে। এই সাতটি পদার্থ হল দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। বৈশেষিক দর্শনে পরমাণুতত্ত্বই সমধিক প্রসিদ্ধ।
সাংখ্য দর্শন:-
সাংখ্য দর্শনকে সর্ব প্রাচীন দর্শন বলে মনে করা হয়। কপিলমুনি এই দর্শনের সূত্রকার। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকা এই দর্শনের প্রাপ্ত গ্রন্থাদির মধ্যে আদি গ্রন্থ রূপে বিবেচিত। সাংখ্য দর্শন দ্বৈতবাদী। মোট ২৫টি তত্ত্ব এই দর্শনে স্বীকৃত। এদের মতে জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। সাংখ্য দর্শনে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ এই তিনটি প্রমাণ স্বীকৃত।
যোগ দর্শন:-
সাংখ্য ও যোগ দর্শন সমানতন্ত্র। সাংখ্য দর্শনের ২৫টি তত্ত্বের সঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্বও যোগ দর্শনে স্বীকৃত। ঋষি পতজ্ঞলি এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। বেদব্যাসের ব্যাসভাষ্য যোগসূত্রের প্রাচীন ভাষ্যগ্রন্থ। যোগ দর্শন যোগ বা সমাধির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই দর্শনে জগতের পরিণামের হেতুরূপে ঈশ্বর স্বীকৃত। এই মতে অষ্টাঙ্গ যোগের মাধ্যমে জীব দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। সাংখ্য দর্শনের ন্যায় যোগ দর্শনও
প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ - এই তিনটি প্রমাণ স্বীকার করে।
মীমাংসা দর্শন:-
জৈমিনি মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পূর্বমীমাংসাসূত্র এই সম্প্রদায়ের মূল গ্রন্থ। বেদের কর্মকাণ্ডের উপর এই দর্শন প্রতিষ্ঠিত। এই মতে বেদ অপৌরুষেয়। সুতরাং ঈশ্বর স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। মীমাংসা সম্প্রদায় প্রভাকর ও ভাট্ট এই দুই উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। প্রভাকর সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ,অনুমান, উপমান, শব্দ ও অর্থাপত্তি এই পাঁচটি প্রমাণ এবং ভাট্ট সম্প্রদায় এই পাঁচটি ছাড়াও অনুপলব্ধি নামক স্বতন্ত্র ষষ্ঠ প্রমাণ স্বীকার করে।
বেদান্ত দর্শন:-
উপনিষদ্ভিত্তিক দর্শন বা উপনিষদের দর্শনকে বলা হয় বেদান্ত দর্শন। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্-প্রতিটি বেদ এই চারটি অংশে বিভক্ত। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত, আরণ্যক ও উপনিষদ্ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। কর্মকাণ্ড ক্রিয়াপ্রধান ও জ্ঞানকাণ্ড বিচার প্রধান। বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্র রচনা করে বেদান্তকে এক যুক্তিনির্ভর দর্শন সম্প্রদায়ে পরিণত করেন। তাই ব্রহ্মসূত্র-ই বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ।
বেদান্ত দর্শনের নয়টি উপসম্প্রদায় আছে। যার মধ্যে অন্যতম দুটি উপসম্প্রদায় হল অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন ও বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন।
শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের শারীরকভাষ্য রচনা করে বেদান্তের যে উপসম্প্রদায় সৃষ্টি করেন অদ্বৈতবেদান্ত নামে পরিচিত। অদ্বৈতবেদান্তের মূল বক্তব্য হল ব্রহ্মসত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ।
ব্রহ্মসূত্রের উপর শ্রীভাষ্য রচনা করে রামানুজ যে নতুন বেদান্ত-উপসম্প্রদায় প্রবর্তন করেন তার নাম বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন।এরা তিনটি প্রমাণ স্বীকার করে- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ।
সবশেষে একটি কথা আস্তিক ও নাস্তিক বলতে আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী একথা বলে থাকি; কিন্তু এটি সঠিক নয়। কারণ এমন আস্তিক সম্প্রদায় রয়েছে যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। তাই সঠিক কথাটি হল যারা বেদে বিশ্বাসী তারা আস্তিক আর যারা বেদে অবিশ্বাসী তারা নাস্তিক।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন