ভূতুড়ে গ্রাম কুলধারা
ভারতের জমির দিক থেকে বৃহত্তম রাজ্য রাজস্থানের জয়সেলমের শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পরিত্যাক্ত গ্রাম কুলধারা। মনে করা হয় এই গ্রাম হল ভূতুড়ে। এই পরিত্যাক্ত গ্রামে যারাই নাকি নতুন করে বসতি গড়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই 'ভূতের' কবলে পড়েছে। ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল সোসাইটি থেকে কুরাধারায় পরীক্ষা করতে আসে এবং তাঁরা এই গ্রামে রাতও কাটিয়েছেন। তাঁদের দাবি, রাতে তাঁরা ছায়ামানবের চলাফেরা করতে দেখেছেন। কিছু অশরীরী গলার স্বর শুনতে পেয়েছেন। আবার অনেকে নিচু স্বীরে কথা বলেছিলেন বলেও দাবি। তবে কুলধারার আশেপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা অবশ্য ভুতুড়ে কোনও ঘটনার কথা কখনও স্বীকার করেননি। অবশ্য তাঁদের মধ্য অনেকে এই গ্রামকে ঘিরে প্রচলিত প্রাচীন কাহিনীতে বিশ্বাস করেন।
লোককথা অনুযায়ী, কুলধারায় বসবাসকারী পালিওয়াল ব্রাহ্মণেরা উনিশ শতকের গোড়ায় শাসক সেলিম সিং-এর অত্যাচারে গ্রাম পরিত্যাগ করেন। অভিযোগ, গ্রামের প্রধানের কন্যার উপর সেলিমের কুনজর পড়েছিল। তিনি জোর করে ওই তরুণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। সেলিম ঘোষণা করে দেন, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রধানের কন্যাকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে, তা না হলে ফল ভাল হবে না। গ্রামে লুটপাট এবং অত্যাচার চালানোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন সেলিম। কুলধারা প্রদেশের মোট ৮৪টি গ্রামের পালিওয়াল ব্রাহ্মণ পরিবার সেলিমের এই ঘোষণার পর একজোট হয়ে তাঁরা সেলিমের দাবি কিছুতেই মেনে নিতে চাইলেন না। অথচ, শাসকের রোষের মুখেও পড়তে চাননি কেউ। ফলে তাঁরা একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।
এক রাতে তাঁরা প্রধানের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শাসকের চোখ এড়িয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। যে, যে অবস্থায় ছিলেন, সে সেই অবস্থাতেই গ্রাম ছাড়েন। সকলে একসঙ্গে এক রাতে যেন স্রেফ কপ্পুরের মতো উবে গিয়েছিলেন। এত মানুষ কোথায় গেলেন, আর কখনও তা জানা যায়নি। কুলধারায় এই পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের আর কোনও খোঁজ পায়নি ইতিহাস। কথিত আছে, নিরুপায় হয়ে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে অত্যাচারী সেলিম এবং গোটা গ্রামের উপরেই অভিশাপ দিয়ে যান গ্রামবাসীরা। তাঁদের অভিশাপের কারণে আর কেউ কখনও ওই গ্রামে থাকতে পারেননি। গ্রামটি সেই থেকে পেয়েছে ‘ভূতুড়ে’ তকমা।
অবশ্য ইতিহাসবিদ এবং গবেষকেরা জানাচ্ছেন, উনিশ শতকে থর মরুভূমির বুকে কুলধারা গ্রামটি খালি হয়ে যাওয়ার অন্যতম মূল কারণ হতে পারে প্রবল জলসঙ্কট। গ্রামের কুয়ো এবং জলাধারগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই গ্রামটিতে আর কেউ থাকতে পারেননি। পরিসংখ্যান বলছে, সতেরো কিংবা আঠেরো শতকে কুলধারার জনসংখ্যা ছিল ১৫৮৮। ১৮১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮০০-তে। ১৮৯০ সালে দেখা যায় কুলধারায় রয়েছেন মাত্র ৩৭ জন গ্রামবাসী। ধীরে ধীরে তাঁরাও গ্রাম ছাড়েন। কোনও এক বিশেষ রাতে গ্রাম ছেড়ে একযোগে সকলের অন্তর্ধানের কথা ইতিহাসে বলা নেই।
২০১৭ সালে ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কুলধারা ছেড়ে গ্রামবাসীদের অন্তর্ধানের অন্যতম কারণ সম্ভবত ভূমিকম্প। কুলধারার বাড়িঘর এখন যে অবস্থায় পাওয়া যায়, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সেই ক্ষয়ক্ষতি সম্ভব নয়। ভূমিকম্পের ফলে বড়সড় ধাক্কা খেয়ে ঘরবাড়িগুলি ভেঙে পড়েছিল বলে দাবি গবেষকদের একাংশের। তবে কুলধারা খালি হয়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসাবে অবশ্যই উঠে আসে অত্যাচারী সেলিম সিংহের নাম। তিনি পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের উপর বহু কর আরোপ করেছিলেন। তার ফলেই কেউ থাকতে পারেনি এই গ্রামে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন