রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বিখ্যাত দার্শনিক
অ্যারিস্টট্লের বক্তব্য ছিল, যে-মানুষ সমাজে
বাস করে না, সে হয় পশু, নয় ঈশ্বর।
অ্যারিস্টট্ল সমাজ ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকেই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের স্বাভাবিক প্রবণতা অর্জন করেছে।খাদ্য,
আশ্রয় ইত্যাদি জৈবিক চাহিদাগুলির তাগিদে মানুষ যে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন
গড়ে তোলে, তার থেকেই জন্ম নেয় পরিবার। ক্রমশ পারিবারিক
প্রয়োজনের গণ্ডি ছাড়িয়ে গড়ে ওঠে গ্রামব্যবস্থা। ক্রমে অনেক গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠে
নগররাষ্ট্র। বিবর্তনের এক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পরিণত হয়েছে আধুনিক জাতীয় সার্বভৌম
রাষ্ট্র।
পণ্ডিতদের মতে, রাজনীতি বা 'পলিটিক্স' শব্দটি
গ্রিক শব্দ 'Polis' থেকে এসেছে। 'পলিস' শব্দের
অর্থ হল নগর। অ্যারিস্টট্ল তাঁর Politics গ্রন্থে 'পলিস' সম্পর্কে বিশদে
আলোচনা করেছেন। অবশ্য প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলির নীতি ও সমস্যা সম্পর্কে
আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যে 'রাজনীতির' কথা
তুলে ধরেন তার সঙ্গে বর্তমানের রাজনীতি-সম্পর্কিত ধারণার কোনো মিল দেখা যায় না।
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রোটাগোরাস, ইউরিপিডিস, অ্যালসিডামাস, অ্যান্টিফোন
প্রমুখ প্রাচীন গ্রিসের সফিস্ট চিন্তানায়কদের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তা প্রথম পরিলক্ষিত
হয়। প্রোটাগোরাসের চিন্তায় মানবতাবাদের ইঙ্গিত মেলে। তাঁর মতে, মানুষের যথার্থ পাঠ্যবস্তু হল মানুষ নিজেই। ইউরিপিডিসের রচনায় জন্মগত
সামাজিক বৈষম্য, এমনকি তৎকালীন গ্রিক সমাজে প্রচলিত ক্রীতদাস
প্রথার বৈধতাকেও অস্বীকার করা হয়। ইউরিপিডিসের বক্তব্য ছিল, ক্রীতদাসের
লজ্জা পাওয়ার মতো একটি বিষয় আছে, সেটি হল তার নাম। এছাড়া
অন্য কোনো ক্ষেত্রে সে অধম নয়। অ্যালসিডামাস বলতেন ঈশ্বর সব মানুষকে স্বাধীন করে
সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতি কোনো মানুষকে ক্রীতদাস করেনি।
পরবর্তীকালে সক্রেটিস সফিস্টদের বিক্ষিপ্ত ভাবধারাগুলি অতিক্রম করে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত দর্শন গড়ে তোলেন। সক্রেটিসের প্রচারিত তত্ত্বের মূল কথা-সদ্গুণই হল প্রকৃত জ্ঞান, তা শেখা যায় আবার শেখানোও যায়। সক্রেটিসের চিন্তাধারায় প্রভাবিত তাঁর সুযোগ্য ছাত্র গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Republic-এ ন্যায়নীতি-সম্পর্কিত মৌলিক ধারণা ব্যাখ্যা করেন। প্লেটো তাঁর রচনায় 'দার্শনিক শাসকদের' (Philosopher king) হাতে রাষ্ট্রপরিচালনার পূর্ণ অধিকার তুলে দিয়েছিলেন। বিচ্ছিন্ন স্বার্থপর মানুষের ধারণাকে বর্জন করে তিনি সামাজিকতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। প্লোটোর ছাত্র অ্যারিস্টট্ল সর্বপ্রথম রাজনীতিচর্চাকে একটি ব্যাপক বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেন। এই কারণে তাঁকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর Politics গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্র-সম্পর্কিত আলোচনায় প্লেটোর চিন্তার সঙ্গে তাঁর মৌলিক পার্থক্য ফুটে ওঠে। তাঁর মতে, ভালো রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, আইনই হবে চরম সার্বভৌম। গ্রিসের ১৫৮টি নগররাষ্ট্রের সাংবিধানিক ইতিহাস সংগ্রহ অ্যারিস্টট্ল চিন্তায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। তিনি মনে করতেন আইনের সার্বভৌমিকতা, নাগরিকদের স্বাধীনতা ও সাম্য, সাংবিধানিক সরকার এবং সভ্য জীবনের উপযোগী মানুষ গড়ে তোলার নৈতিক আদর্শেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন