সমাজজীবন বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণার উদ্ভব ঘটে। বহুকাল যাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছিল
নীতি-দর্শনের পর্যায়ভুক্ত। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের নবজাগরণের পথিকৃৎ মেকিয়াভেলির
হাতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্ম হয়। খ্রিস্টীয় দর্শনের যুক্তি, ধর্ম, নৈতিকতা প্রভৃতিকে বর্জন করে মেকিয়াভেলি
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও
কুসংস্কারাচ্ছন্ন গতানুগতিক চিন্তাকে অতিক্রম করে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত শক্তিশালী
জাতীয় রাষ্ট্রের রাজকীয় সার্বভৌমত্বের কথা তুলে ধরে মেকিয়াভেলি এক নতুন রাজনৈতিক
দর্শনের অবতারণা করেন। মেকিয়াভেলির উত্তরসূরি জাঁ বোদাঁ এবং টমাস হব্স্ ধর্মীয়
প্রভাবমুক্ত, শক্তিশালী রাষ্ট্রদর্শনের সূচনা করেন। মধ্যযুগে
ফরাসি সমাজে ধর্মের নামে যে অনাচার ও নৈরাজ্য কায়েম হয়েছিল তার হাত থেকে দেশকে
মুক্ত করার জন্য এক শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বোদাঁ বলেছিলেন।
সমকালীন সমাজের অব্যবস্থার জন্য চার্চকে দায়ী
করে হব্স্ এক চরম সার্বভৌম শক্তির প্রতীক হিসেবে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ের রাজনীতিচর্চায় রাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে জনগণের সার্বভৌমত্বকে
প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব, ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের নেপথ্যে
লকের অধিকারের তত্ত্ব এবং রুশোর গণসার্বভৌত্বের তত্ত্ব যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি
করেছিল। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই রাজনৈতিক চিন্তায় এক নতুন ধারার সূচনা ঘটে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিচর্চায় দেখা
দেয় এক বৈপ্লবিক উত্তীরণ। এই সময় একদিকে
ভাববাদ, হিতবাদ, উদারনীতিবাদ
এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দর্শন, অন্যদিকে বস্তুবাদী
মার্কসীয় দর্শনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। লেনিন পরবর্তীকালে মার্কসবাদের এক ধ্রুপদী
ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। পরে এডওয়ার্ড বার্নস্টাইন, কার্ল
কাউটস্কির মতো একদল চিন্তাবিদ সমাজবাদ সম্পর্কে এক ভিন্ন ধারার প্রবর্তন করেন।
তাঁরা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেন। একে গণতান্ত্রিক
সমাজবাদ বলা হয়।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
চিরাচরিত রাজনীতিচর্চার বাইরে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। এঁদের মধ্যে গ্রাহাম
ওয়ালাস, আর্থার বেন্টলি, চার্লস
মেরিয়াম, ডেভিড ইস্টন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আচরণবাদ
রাজনীতিচর্চায় তত্ত্বকেন্দ্রিক ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনাকে পরিত্যাগ করে ব্যক্তি
ও গোষ্ঠীর আচার-আচরণ বিশ্লেষণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সর্বতোভাবে মূল্যমান-নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার এক প্রয়াস
চালায় আচরণবাদ। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে রাজনীতিচর্চায় আচরণবাদোত্তর
ধারার জন্ম হয়।
রাজনীতিচর্চার প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ত
পরিবর্তনশীল। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সাম্প্রতিককালের
রাজনীতি মূলত সমাজনির্ভর। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সাবেকি আলোচনায় রাজনৈতিক জীবনের
পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যেত না। শাসনবিভাগ, আইনবিভাগ, বিচারবিভাগ, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান
প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির আলোচনার মধ্যেই তা সীমিত ছিল। এই কারণে আধুনিক
রাজনৈতিক আলোচনায় রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী,
স্বার্থগোষ্ঠী, ভোটদাতাদের নির্বাচনি আচরণ,
রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, জনমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রভৃতি
বিষয়কে অধিকতর গুরুত্বসহ পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন
করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
একালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতির মুখ্য বিষয় হিসেবে ক্ষমতার (Power) প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। রবার্ট ডালের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল মানবিক সম্পর্কের এমন এক নিরবচ্ছিন্ন ধারা যার সঙ্গে ক্ষমতা, শাসন বা কর্তৃত্ব জড়িত। ("A political system is a persistent pattern of human relationships that involves power, rule or authority")
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন