রবিবার, ২০ মার্চ, ২০২২

ভারত কিভাবে পোল্যান্ডকে সাহায্য করেছিল?

 কিভাবে
একজন ভারতীয় রাজা পোল্যান্ডের শিশুদের সাহায্য করেছিল
?

ইতিহাসে
ভারত বা ভারতীয়রা বহু দেশকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে। যা বর্তমান ভারতীয়দের
বিভিন্ন সমাজে বা দেশে চলতে সাহয্য করে। কিন্তু ঘটনা চক্রে ভারতীয়দের সেই সব
ইতিহাস-কে ভারতীয় ইতিহাসবীদরা পাঠ্য পুস্তকে স্থান দেয়নি। তাতে বিভিন্ন সমস্যার
সৃষ্টি হয়েছে। তার একটি বর্তমান উদাহরণ হল-ইউক্রেনে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের উপর
অত্যাচার
, অথচ
তারই প্রতিবেশী দেশ পোল্যাণ্ড-এ ভারতীয়দের-কে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়
, তা কিন্তু অনেক ভারতীয় জানে না। অথচ এত
ভারতীয় ইউক্রেনে যাবার বদলে যদি পোল্যাণ্ডে পড়াশুনো করতে যেতো তাহলে তাদের সঙ্গে
এমন দুর্ব্যবহার বা অ-কারণে অত্যাচারিত হতে হতো না।



পোল্যাণ্ডে
একটি ভারতীয় রাজার নামে রাস্তা
, স্কুল, বৃত্তি প্রদান প্রভৃতি আছে।শুধু তাই নয়
তারা এই রাজাকে
THE GOOD
KING
বা ভালো রাজা বলে থাকে।
কিন্তু কেন এ প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগছে। আবার অনেকে এখনকার পত্রিকা পড়ে জেনে
নিয়েছেন যে পোলিশ লোকদের রাজা স্বরণ দিয়েছিল তাই। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু পোলিশ লোক অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাহলে এই ভারতীয়
রাজাকেই পোলিশ জনমানব কেন এত সম্মান দেয়
??



এবারে
আসি পোল্যাণ্ডবাসী ভারতীয়দের কেন এত সম্মান দেয় সে সম্পর্কে। ১৯৩৯ সালের ১লা
সেপ্টেম্বর জার্মান সৈন্যরা পোল্যাণ্ড আক্রমণ করে। আর এটিই ছিল দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। এর ঠিক ১৬দিন পরে অর্থাৎ ১৯৩৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর
, পোল্যাণ্ডের অবশিষ্ট অঞ্চল সোভিয়েত ইউনিয়ন
আক্রমণ করেছিল। এদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের মানচিত্র থেকে পোল্যাণ্ড-কে
চিরতরে মুছে ফেলা।



মস্কোতে
১৯৩৯ সালের ২৩শে আগষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানির মধ্যে রিবেনট্রপ মোলোটভ নামে
একটি গোপন চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যেখানে বলা ছিল তারা পরস্পরের উপর আক্রমণ করবে না
এবং পোল্যাণ্ড-কে টুকরো করার একটি গোপন শর্ত ছিল। ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৪১
সালের জুন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তপক্ষ পোল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চল থেকে পোলিশ
নাগরিকদের সোভিয়েত ইউনিয়নের সুদূর উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সাইবেরিয়াতে নির্বাসনের
চারটি বড় অভিযান চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের হিসাব অনুযায়ী এতে ৩ লাখ ২৫ হাজার পোলিশ
নাগরিক প্রভাবিত  হয়েছিল যদিও পোল্যাণ্ড
দাবি করে আরো অনেক বেশী নাগরিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।অন্যদিকে ১৯৪১ সালে জার্মানির
হামলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন খানিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে পোল্যাণ্ডের কিছু বাসিন্দাকে
রাশিয়া ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়।সাইবেরিয়ার কড়া ঠান্ডা থেকে বাঁচার তাগিদে এই
বাসিন্দারা অনেক ইউরোপীয় এবং এশীয় দেশে বাসস্থানের খোঁজ করলেও বেশির ভাগ দেশই
তাঁদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।



এমত-অবস্থায়
নির্বাসনে থাকা পোল্যাণ্ড সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও সশস্ত্র সেনাবলের প্রধান
"ভ্লাদিস্লাভ সিকোর্স্কি" ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
"উইনস্টন চার্চিল"-কে চিঠি লিখে অনুরোধ করে যে পোল্যাণ্ডে যুদ্ধে
ক্ষতিগ্রস্থ পোলিশ শিশুদেরকে বাঁচাতে। এই নিয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের ওয়ার ক্যাবিনেটে
একটি চর্চা শুরু হয়। আর এই ওয়ার ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন মহারাজা দিগ্বিজয়সিংজি।
এখান থেকেই তিনি পোলিশ নাগরিকদের এমন অবস্থার কথা জানতে পারেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন
তখনকার ভারতীয় রাজাদের সভাকক্ষের প্রধান ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের
প্রস্তাব দেন যে তিনি পোলিশ শিশুদের নিজ খরচায় নিজের রাজ্যের মধ্যে আশ্রয় দেবেন।
এর জন্য মহারাজাকে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রচুর অর্থও ব্যয়
করতে হয় তাঁকে। কিন্তু কোনও বাধাই তাঁর এই সদিচ্ছাকে দমাতে পারেনি।তাঁর পুরো নাম
ছিল দিগ্বিবিজয়সিংহজি রঞ্জিৎসিংহজি জাডেজা
তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত
গুজরাতের নওয়ানগরের (বর্তমানে যার নাম জামনগর)
জাম সাহেব অর্থাৎ মহারাজা ছিলেন।



পোলিশ
এই এক হাজার বাচ্চারা সোভিয়েত ইউনিয়ন যা বর্তমানের রাশিয়া থেকে ইরান
, আফগানিস্তান এবং আজকেগার পাকিস্থান হয়ে
ভারতের নওয়ানগরে এসে পৌছায়। সেখানে মহারাজা তাদের বালাচাদি
-তে (Balachadi) থাকবার
ব্যবস্থা করেন। তারপর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন মহারাজা। ডাক্তার
অমৃতলাল আশানি ও ঔষধ প্রস্তুতকারক আনন্দ আর যোশী-কে আজও পোল্যাণ্ডের নাগরিকরা
অন্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করেন। এই সময়ের একটি মজাদার ঘটনা হল পালং শাকের
ধর্মঘট। প্রথমে কয়েক সপ্তাহ ধরে এই বাচ্চাদের কেবল পালং শাকের তারকারি দেওয়া হত।
কারণ পালং হল অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর একটি খাবার কিন্তু এটা তারা খেতে পারতো না। তাই
বড় ছেলেরা সংঘঠিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডেকেছিল।তাদের খাবার দিলে তারা ফেলে দিত
, আর এভাবেই তারা পালং শাক খাবার হাত থেকে
মুক্তি পেয়েছিল। 
মহারাজা তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি কতটা নজর রেখেছিলেন তা একটি ঘটানা
থেকেই জানা যায়। একজন পোলিশ ব্যাক্তি বলেছিলেন যে তিনি স্কাউট খেলতে খুব ভালো
বাসতেন।ছোটবেলার অসুস্থতা এবং পোল্যাণ্ডের যুদ্ধের কারণে তার সে সুযোগ হয়নি।
কিন্তু যখন যে মহারাজার আশ্রয়ে এসে উঠলো তার স্বাস্থ্য অত্যন্ত ভালো হয়ে উঠেছিল
এবং সে স্কাউট লেখার উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল।



মহারাজা
কেবল তাদের স্বাস্থ্যের দিকেই নজর রাখতেন না
, যাতে
পোলিশ সংস্কৃতি নষ্ট না হয়
, সেদিকেও
খেয়াল রেখেছিলেন। বালাচাঁদী ছিল তাৎকালীন বিশ্বের কয়েকটি স্থানের মধ্যে একটি
যেখানে বছরের ৩৬৫ দিন পোলিশ বাচ্চাদের উপস্থিতিতে পোল্যাণ্ডের পতাকা উত্তোলন করা
হত। মহারাজা এই বাচ্চাদের পড়াশুনো-এর ব্যাবস্থা করেছিলেন। যেহেতু বাচ্চাদের
কলোনিতে ঘর ছিল না
, তাই
মহারাজা তাঁর অথিতিশালা-টিকে স্কুলে পরিণত করে নিতে বলেন।এই স্কুলের জন্য রাজা ও
রাণী অনেক চেয়ার ও টেবিল দিয়েছিলেন। এছাড়াও রাজা তাদের পড়াশুনোর জন্য পাঠ্য বইয়ের
ব্যবস্থা করেছিলেন।বাচ্চাদের সরঞ্জামের অভাব ছিল
, তাই
মহারাজা তাদে বল
, ভলিবল
এবং বাস্কেটবল
, ফুটবল
ইত্যাদির সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। বাচ্চাদের খেলাধুলার সরঞ্জামের অভাব ছিল
, তাই মহারাজা তাদের বল, ভলিবল এবং বাস্কেটবল, ফুটবল ইত্যাদির সরঞ্জাম সরবরাহ করতেনএভাবেই ভারতে গড়ে ওঠে লিট্‌ল পোল্যাণ্ড
শরণার্থী অনাথ শিশুদের নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন
তিনি। এই শিশুরাও তাঁকে
বাপু বলেই ডাকত।



ইউরোপে
যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পোল্যাণ্ডে কমিউনিস্ট শাসনছিল। অন্যদিকে ভারত স্বাধীনতার
দোরগোড়ায় পৌছে গিয়েছিল। "জাম সাহেব" সমেত ভারতীয় রাজাদের সামাজিক
স্বীকৃতি ও কদর কমতে থাকে। ১৯৪৩ সাল থেকে ভারতের ভালীভাদী
(Valivade), মহারাষ্ট্রতে একটি পোলিশ কলোনি ছিল। যেখানে
বাপুর কিছু বাচ্চা ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ছিল। ১৯৪৬ সালে বালাচাঁদীতে
অনাথালয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ওখানে থাকা বাচ্চাদের ভালীভাদী-তে
(Valivade) পাঠিয়ে
দেওয়া হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন পোলান্ড সরকারকে স্বীকৃতি দিলে এই
শরণার্থীদের নিজেদের দেশে ফিরে আসতে বলা হয়।তাঁর অসামান্য কৃতীত্বের জন্য
দিগ্বিবিজয়সিংহজিকে পোল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দেওয়া হয়। তাঁর নামাঙ্কিত
রাস্তা এবং ছোটদের স্কুলেরও দেখা মেলে পোল্যাণ্ড গেলে।

মহারাজা দিগ্বিবিজয়সিংহজি রঞ্জিৎসিংহজি জাডেজা কে ছিলেন?

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন