নকুল-ব্যাঘ্র-
জম্বুক-বৃক-মুষিককথা বর্ণনা
পুরাকালে
কোন বনে একটি জম্বুক অর্থাৎ শৃগাল, একটি
ব্যাঘ্র, একটি
মূষিক অর্থাৎ ইন্দুর, একটি
বৃক অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ এবং একটি নকুল অর্থাৎ নেউল বা বেজি পরস্পর বন্ধুভাবে বাস
করত। শৃগাল অতি ধূর্ত, বুদ্ধিমান
ও স্বার্থপর ছিল। তারা একদা বনের মধ্যে একটি হৃষ্টপুষ্ট হরিণকে (কাশীরামে গর্ভিণী
হরিণীকে) আক্রমণ করার চেষ্টা করে বিফল হয়। শৃগালের ! বুদ্ধিতে ইন্দুর মাটিতে গর্ত
খনন করে বিশ্রামরত হরিণের কাছে পৌঁছে তার পায়ের শিরা ! কেটে দিল। ব্যাঘ্র
অনায়াসে হরিণকে বধ করল। ধূর্ত শৃগাল মৃত হরিণটিকে আগলে রেখে সকলকে স্নান করে এসে
মাংস ভক্ষণ করতে বলল। চারজনই স্নানের জন্য নদীতীরে গমন করল।
প্রথমে ব্যাঘ্র ফিরে এসে শৃগালকে কপটভাবে চিন্তান্বিত দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করল।
শৃগাল বলল, 'হে
মহাবীর। তোমার আগেই ইন্দুর এসে বলে গেছে যে, তুমি
নাকি তারই সহায়তায় হরিণকে বধ করে বৃথাই আত্মগর্ব করছ। এরই প্রতিবাদস্বরূপ সে
হরিণ মাংস বর্জন করে অন্যত্র চলে গেল।' তখন
ব্যাঘ্র ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, 'হে
শৃগাল! তুমি ঠিক সময়েই আমাকে কথাটা জানালে। আমি তবে নিজের শক্তিতেই শিকার ধরে
ভক্ষণ করব। আমি বনান্তরে চলে যাচ্ছি।'
এরপরই
ইন্দুর এলে শৃগাল তাকে বলল, 'হে
ইন্দুর, পলায়ন
কর। নেকড়ে বলেছে যে, এই
হরিণের মাংসে তার নাকি অভিরুচি নেই। সে তোমাকে বধ করে খেতে চায়।' ভীত ইন্দুর সঙ্গে সঙ্গে
গর্তের মধ্যে প্রবেশ করল। কিছুকাল পরে নেকড়ে বাঘ ফিরে এলে শৃগাল বলল, ‘ভাই
! না জানি ব্যাঘ্র তোমার ওপর কি কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে তোমাকে হত্যার জন্য খুঁজছে।' মাংসাশী নেকড়ে বাঘ ভীত ও
সঙ্কুচিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেইস্থান থেকে পলায়ন করল। এই অবসরে নেউল বা বেজি স্নান
করে এলে শৃগাল রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগল, ‘ওহে বেজি। আমি নিজের শক্তিতে ব্যাঘ্র, ইন্দুর ও নেকড়ে বাঘকে পরাস্ত
করেছি। তারা আমার ভয়ে এই বন পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছে। তুমি আমার সাথে যদি
যুদ্ধে জয়লাভ করতে পার তবেই এই হরিণের মাংস ভক্ষণ করতে পাবে।' নেউল বা বেজি প্রাণভয়ে
পলায়ন করবার আগে বলে গেল, ‘হে শৃগাল। শক্তিশালী ব্যাঘ্র ও নেকড়ে বাঘ
এবং বুদ্ধিমান্ ইন্দুর যেখানে পরাজিত হয়েছে, সেখানে
আমি তো তুচ্ছ। আমার হরিণ মাংসে দরকার নেই।'
এইভাবে
শৃগাল অসাধারণ বুদ্ধিবলে সকলকে বিদায় করে পরমসুখে একাকী হরিণমাংস ভক্ষণ করেছিল।
এই
কাহিনী থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, যে
ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ শৃগালের মতো আচরণ করেন তিনি চিরকাল সুখভোগ করে থাকেন। ভীত
ব্যক্তিকে ভয় প্রদর্শন, বীরের
নিকট বিনয়ভাব, লুব্ধকে
অর্থদান, সম
বা ন্যূন ব্যক্তিকে বল প্রকাশ করে বশীভূত করা উচিত। পুত্র, সখা, ভ্রাতা, পিতা এবং গুরুও যদি শত্রুর
মতো বিদ্রোহাচরণ করেন, তাহলে
তৎক্ষণাৎ তাঁদের বিনষ্ট করা প্রয়োজন। ব্যাধি, অগ্নি
ও ঋণ কখনও পোষণ করে রাখা উচিত নয়, কারণ
দিনে দিনে সেগুলি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে। সেইরকম
শত্রুকেও শপথ, অর্থদান, বিষপ্রয়োগ বা মায়া প্রকাশ
করে বিনাশ করা বিধেয়, কখনও
উপেক্ষা করা সঙ্গত নয়। কোন শত্রুকে একবারও দণ্ড দান করে যে রাজা ধন-মান ইত্যাদি
প্রদানপূর্বক অনুগ্রহ করেন তিনি নিজের মৃত্যু সংগ্রহ করে রাখেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন