ইংরেজ
আমলে দ্বীপান্তরের জায়গা
ভারত
মহাসাগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৫৭২টি ক্রান্তীয় দীপকে একত্রে বলা হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। তার মধ্যে মাত্র ৩৮টি দ্বীপে মানুষের বসতি
আছে। এই
দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম রস আইল্যান্ড। এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ জরিপকর্মী স্যার
ড্যানিয়েল রসের নামে। পোর্টব্লেয়ার বন্দরকে পাহারা দেওয়ার কাজে তিনি এই দ্বীপকে
চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ শাসনে এই দ্বীপই ছিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের হেড
কোয়ার্টার। ড্যানিয়েল রসের পাশাপাশি যাঁর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন আর্চিব্যাল্ড
ব্লেয়ার। তিনিও ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক জরিপকর্মী। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে
তাঁর নামে পোর্ট ব্লেয়ারের নামকরণ করা হয়। তার আগে এর নাম ছিল পোর্ট কর্নওয়ালিস।
কিন্তু এই ভূখণ্ডের থেকেও বেশি বাসযোগ্য ছিল রস আইল্যান্ড। কারণ সেখানে পরিস্রুত
জল সহজলভ্য ছিল।
আন্দামানে
ব্রিটিশদের পা পড়ার প্রায় ষাট বছর পরে সিপাহি বিদ্রোহের বন্দিদের আনা হয় এখানে।
৭৭৩ জন বন্দিকে নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছন জেলার জেমস প্যাটারসন, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ। তার চারদিন পরে কলকাতা থেকে আন্দামানে পা
রাখেন আরও ২০০ বন্দি। তাঁরা ছিলেন মূলত সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের
প্রতিবাদীরা। জেলর প্যাচারসেনর নির্দেশে তাঁদের পাঠানো হল রস দ্বীপে। নির্মম
অত্যাচারের মধ্যে তাঁদের লাগানো হল বন কেটে বসতি তৈরির কাজে। নিজেদের থাকার ছাউনি
থেকে সাহেবদের বাংলো, তৈরি
হতে লাগল অনাহারী বন্দিদের শ্রমে।
০.৩ বর্গকিমি আয়তনের এই দ্বীপ তখন ঘন বনে ঢাকা। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের একটি নথি থেকে জানা
যায়, দ্বীপান্তরে
থাকা বন্দিদের যথেচ্ছ মৃত্যু হত ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া
এবং পেটের অসুখে। সে সময় তাঁদের উপর কুইনাইন ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতেন
শাসকরা। সে সময় দশ হাজার বন্দিকে জোর করে কুইনাইন খাওয়ানো হয়েছিল বলে নথিতে দাবি।
অভিযোগ, এর
ফলে তাঁরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ অবধি এই ‘কালাপানি’ বন্দিশালা পাহারার দায়িত্বে ছিলেন ২৪ জন চিফ
কমিশনার।
১৯৪১
সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু তাতে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি পোর্টব্লেয়ার বা রস আইল্যান্ডের ব্রিটিশ উপনিবেশ। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে জাপানিরা। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ অবধি এই দ্বীপ ছিল
জাপানিদের অধিকারে। সে সময় ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে রস আইল্যান্ডে একদিন ছিলেন নেতাজি
সুভাষচতন্দ্র বসু। পোর্ট ব্লেয়ারে তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনও করেন। সেই ঘটনার স্মরণে ২০১৮ সালে রস
আইল্যান্ডের নতুন নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দক্ষিণ আন্দামান জেলার
এই দ্বীপের পরিবর্তিত নাম হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ। বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের পরে আবার
ক্ষমতায় ফেরেন ব্রিটিশরা। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই
তাঁদেরও ভারত ছেড়ে যাবার সময় হয়ে আসে। এর
পর দীর্ঘদিন রস আইল্যান্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯৭৯ সালে এখানে কেন্দ্র
তৈরি করে ভারতীয় নৌসেনা।
রস
আইল্যান্ডের বাসিন্দা এখন একপাল হরিণ। বিশ শতকের গোড়ায় হরিণদের সেখানে রাখা
হয়েছিল ব্রিটিশদের শিকার শিকার খেলার জন্য। সেই খেলা বন্ধ হয়েছে বহু দিন। দ্বীপের
সবুজকে আশ্রয় করে অতীত কারাগারে নিভৃতবাস করছে হরিণের দল।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন