জেলেরা
হয়ে উঠলেন জলদস্যু
আরব
সাগর ও লোহিত সাগরের মাঝে আফ্রিকার যে অংশটি শিংয়ের মতো দেখতে সেটিই সোমালিয়া।
চিরকালই দারিদ্রের শিকার এই দেশটি। তবে বিগত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে তা চরম আকার
ধারণ করে। ১৯৯১ সালে সোমালিয়ায় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর সোমালিয়ার জলসীমায়
বহু ইউরোপীয় জাহাজ রহস্যজনক ভাবে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। সোমালিয়া উপকূলের কাছে
বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে তারা। জলের তোড়ে ভেসে আসা ওই সব ব্যারেলে
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ থাকত। এই সব বর্জ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে সোমালিয়ার
উপকূলবাসীরা অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। নানা রকম অদ্ভুত রোগ দেখা দেয় তাঁদের
মধ্যে। এমনকি গর্ভবতীরা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিতে শুরু করেন। ২০০৫ সালে সুনামির
পর এই রকম হাজার হাজার ব্যারেলে ভরে যায় সোমালিয়ার উপকূল অঞ্চল। জানা যায়, ইউরোপের বিভিন্ন হাসপাতাল ও
কারখানা থেকে ইতালীয় মাফিয়াদের হাত ঘুরে ওই সব বর্জ্য পদার্থ সোমালিয়ার উপকূলে
খালাস করা হচ্ছিল, যার
মধ্যে সীসা, ক্যাডমিয়ামের
মতো ক্ষতিকারক পদার্থ ছিল। এগুলি সোমালিয়ার উপকূল এলাকার জলে মিশতে থাকে। বিষয়টি
জানাজানি হলেও এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি ইউরোপীয় সরকারগুলিকে।
ক্ষতিগ্রস্ত সোমালীয়দের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হয়নি।
ওই
একই সময়ে ইউরোপীয় মাছ ধরার জাহাজগুলি সোমালিয়ার উপকূলে ভিড় করতে থাকে। সেখান থেকে
মাছ লুঠ করে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে তাদের। এতে স্থানীয় জেলেরা
জীবিকাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁরা নিজেরাই এই লুঠ রুখতে তৎপর হন। বেআইনি
ভাবে ইউরোপীয় দেশ থেকে যে সমস্ত জাহাজ তাদের উপকূল থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এবং
ক্ষতিকারক বর্জ্য ফেলে উপকূলকে দূষিত করছিল, তাদের
তাড়াতে সোমালিয়ার উপকূলের অধিবাসীদের একাংশ ছোট ছোট নৌকো এবং স্পিডবোট নিয়ে
নিজেরাই জলে নেমে পড়েন। কিন্তু বড় বড় জাহাজগুলির সঙ্গে কিছুতেই যুঝে উঠতে
পারছিলেন না সোমালিয়ার সাধারণ মানুষ। মাছ ধরার জাহাজগুলির উপর কিছুতেই শুল্ক বসাতে
পারছিলেন না তাঁরা। এমত অবস্থায় বর্জ্য ফেলতে আসা বেশ কিছু জাহাজকে আটক করতে সক্ষম
হন সোমালিয়ার ওই সব সাধারণ মানুষ। আর তাতেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তাঁদের। এ ভাবে
জাহাজ তাড়ানোর চেয়ে সেগুলিকে ছিনতাই করে মুক্তিপণ আদায়ই সহজ বলে মনে হয় তাঁদের
একাংশের। সেই মতো হাতে অস্ত্র তুলে নেন তাঁরা। সেখান থেকেই আধুনিক সোমালিয়ার
জলদস্যুদের উত্থান। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে দেশের স্বৈরাচারী শাসক মহম্মদ সৈয়দ বারের
মৃত্যুর পর দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। চরম অর্থ সঙ্কট দেখা দেয় দেশ জুড়ে। তার
ফলশ্রুতি হিসাবেই সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুদের উত্থান ঘটে, যা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের
ক্ষেত্রে বিভীষিকায় পরিণত হয়।
২০০০
সাল থেকে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলির জন্য রীতিমতো বিভীষিকা হয়ে ওঠে এই
জলদস্যু দলগুলি। বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতাই করে মুক্তিপণের মাধ্যমে টাকা রোজগার
করতে শুরু করে তারা। তবে ২০১৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মহল, রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ন্যাটোর
হস্তক্ষেপে সমুদ্রের বুকে জলদস্যুদের আক্রমণের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন