শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩

ইতিহাসে প্রথম কোলকাতা শব্দটি কোথায় পাওয়া যায়

 

কলকাতা শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পরস্পর সংলগ্ন ডিহি কলিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর - এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করে কলকাতা মহানগরীর উত্থান ঘটে। এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা থেকে কলকাতা শহর হয়েছে বলে ধরা হয়। কিন্তু এই কলিকাতা বা কলকাতা নামটির উৎপত্তি কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।

কলকাতা শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায় পশ্চম শতকের বিপ্রদাস পিপলাই-এর গ্রন্হ মনসামঙ্গল'-এ এবং মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে। এছাড়া কলকাতা নামটি রয়েছে আবুল ফলজের লেখা আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে। তবে স্থানীয় বিজ্ঞজনেদের মতে, মনসামঙ্গলে' এবং চণ্ডীমঙ্গলে'- কলকাতার প্রসঙ্গ প্রক্ষিপ্ত।

তাছাড়া কলকাতায় কালিঘাটের কাছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে গুপ্ত যুগের কিছু মুদ্রা। এর মধ্যে রয়েছে দ্বাদশাদিত্য তৃতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলের তিনটি মুদ্রা এবং বিষ্ণু গুপ্তের আমলের ১৫টি মুদ্রা। এ থেকে অনেকে মনে করে থাকেন কলকাতা কোন আধুনিক কালের শহর নয়, এটি একটি প্রাচীন এলাকা। তবে এর থেকে নামের উৎপত্তির ইতিহাস জানা যায় না। কলকাতা নামের উৎপত্তি প্রসঙ্গে যে ধারণাগুলি  বাজারে প্রচলিত রয়েছে সেগুলি হল-

১) মনে করা হয় কলকাতা নামটি এসেছে মা কালীর পুজো থেকে। জানা যায় তৎকালীন কলকাতায় বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ছিল কালীক্ষেত্র। আর তার অধীশ্বর মা কালী বাস করতেন কলকাতায়। পরে কাপালিকরা এই কালীকে নিয়ে পালিয়ে যায় কালীঘাটের বনে। আর সেই থেকে কালীঘাটে মা কালীর অধিষ্ঠান। এছাড়া দক্ষিণেশ্বরে মা কালীর পূজাকেও অনেকে উল্লেখ করে থাকেন। কারণ এক সময় দক্ষিণেশ্বর ছিল বাংলার রাজধানী।

২) অবশ্য রাধাকান্ত দেব-এর মতে কিল কিলা' অর্থাৎ কিলা বা কেল্লা' থেকে কলকাতা নামটি এসেছে। আর তিনি বলেছেন- কবি রামের বইতেও নাকি তাই আছে।

৩) এছাড়া কলকাতার নামকরণের গবেষণায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে- কলি মানে চুন, আর কাতা মানে ভাটি, অর্থাৎ কলকাতা বা কলিকাতা হচ্ছে চুনের ভাঁটি। শোনা যায় এখানে ছিল জেলেদের বাস, তারা নদী থেকে ধরে আনতো ঝিনুক ও শামুক। সেগুলি পুড়িয়ে চুন তৈরী হত তখন এখানে। সেই চুন বা কলি থেকে কলকাতা।

৪) তাছাড়া আরোও একটি তথ্য উঠে আসে,ক্যালকাটা নামটি এসেছে 'গলগাথা' থেকে। ডাচ ভাষায় 'গল' মানে মড়ার খুলি।"গলগাথা" মানে মরা মানুষের খুলিতে বোঝাই দেশ। প্রথম দিকে কলকাতা এমনটা ছিল বলে, এরকম মনে করা হয়।

৫) আবার অনেকে এই নাম প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ একটি অবাস্তব যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের মতে 'খাল-কাটা' থেকে ক্যালকাটা নামটি এসেছে। কলকাতার লোকেরা বর্গীদের ঠেকাবার জন্য তখন একটা খাল কাটেছিলেন। সেটাই ছিল মারাঠা ডিচ। তার ফলে কলকাতার লোকেদের নাম হয়ে গিয়েছিল ডিচার। সুতরাং খাল কাটা থেকে ক্যালকাটা এসেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এটি একটি অবাস্তব যুক্তি। কেননা ১৭০০ সনের এপ্রিল থেকে কলকাতা বা ক্যালকাটা শহর এসেছে। অথচ বর্গীদের টাইম-টেবিল দেখা যায় তার চল্লিশ বছর পরে।

৬) এছাড়া অনেকে ঘাস কাটা থেকেও কলকাতার নাম এসেছে বলে মনে করেন। কারণ তখন কলকাতা ছিল ঘাসে ভরা এলাকা। তাকে বলা হত ঘেসুড়ে ভাবল। কোন এক সাহেব কোন দিন এক স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করেন এই ঘাস কবেকার কাটা। জবাবে সে বলে- কাল কাটা। আর তারই বিকৃত রূপ হল ক্যালকাটা।

৭) তবে যে ঐতিহাসিক ধারণাটি উঠে আসে সেটি হল- তৎকালীন কলকাতার দক্ষিণোপকূলের একটি জায়গা ছিল কালিকট। সেখানেই প্রথম ঠেকেছিল পশ্চিমের জাহাজ, নোঙর ফেলেছিল পর্তুর্গিজরা। এই কালিকট-ই হল কলকাতার আদি ঐশ্বর্য। তখন ইউরোপে পর্যন্ত ছিল কালিকটের জিনিসের ভীষণ সুখ্যাতি। ইন্ডিয়ান জিনিস বলতেই লোকে জানতো কালিকটের জিনিস, আর এর পরিচিতি ছিল প্যাকিং বাক্সে বা বস্তায় লেখা 'মেড ইন কালিকট' থেকে। অতএব কালিকটকে নিয়ে বিপত্তিতে পড়লেন ইংরেজরা। তারা সেখানে গড়ে তোলেন একটি ফ্যাক্টরি। কিন্তু সমস্যা হল প্যাকিং বাক্সে বা বস্তায় গায়ে লেখা নিয়ে, কারণ মেড ইন হুগলি' বা মেড ইন সুতানটি' বললে বাজারে কেউ এ জিনিস কিনবে না। সেসময়ে বাজারে রমরমা ছিল মেড ইন কালিকটের জিনিস নিয়ে। তাই কোন এক ইংরেজ বুদ্ধি বাতলিয়ে প্যাকিং বাক্সে বা বস্তার গায়ে লিখলেন 'KALKATA' বলে। কালিকটও তখন কে'(K) দিয়ে শুরু আর বানানটাও অনেকটা একরকম। সুতরাং এই ফাঁকি আর খদ্দেরের চোখে ধরা পড়লো না। বাজারে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো সুতানটির জিনিস। আর সেই থেকেই সুতানটি হয়ে গেল কলকাতা।

এর প্রমাণ হিসাবে ধরা হয় ইংরেজদের দ্বারা মিরজাফরকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া, যে আলিনগরকে 'ক্যালকাটা' করতে তাঁর কোন অমত নেই। আর এই খবরটিকে তৎকালীন ইংরেজগণ পলাশীর যুদ্ধের খবরের চেয়েও দ্রুত দেশে পাঠাতে ব্যস্ত হয়েছিলেন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন