জানা যায়, বিভিন্ন
যুগে এই মন্দিরের দায়িত্বে ছিলেন বিভিন্ন রাজপরিবার। আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে
ত্রিবাঙ্কুরের রাজা হন আনিঝাম থুরিনাম যিনি পরিচিত ছিলেন মার্তণ্ড বর্মা নামে।
মার্তণ্ড বর্মা ১৭৫০ সালে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যটি ভগবান পদ্মনাভর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ
করেন। মার্তণ্ড বর্মা শপথ নেন যে, রাজপরিবার
ভগবানের তরফে রাজ্যপাট পরিচালনা করবে এবং তিনি ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা রাজ্যের সেবা
করবে পদ্মনাভ দাস নামে অর্থাৎ ভগবান পদ্মনাভর দাস হিসেবে। তখন থেকে প্রতিটি
ত্রিবাঙ্কুর রাজার নামের আগে পদ্মনাভ দাস কথাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পদ্মনাভস্বামীকে
ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের অনুদানকে ত্রিপদিদানম বলা হয়। গত কয়েকশো বছর ধরে মন্দিরের
দায়িত্বে রয়েছে এই ত্রিবাঙ্কুরের রাজপরিবার। আদিশেষ নাগের উপরে অনন্তশয়ানে বিষ্ণুর
রূপ তাঁদের পরিবারের আরাধ্য দেবতা। বলা হয়, দ্রাবিড়ীয়
এবং চেরা ঘরানায় নির্মিত মন্দিরে যা ধনসম্পদ সঞ্চিত রয়েছে, তা হয়তো পৃথিবীর আর কোনও
মন্দিরে নেই। আর তার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ২০১১ সালে।একটি জনস্বার্থ মামলা
চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খোলা হয়েছিল মন্দিরের সম্পদের ভাণ্ডার।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শাসক, বণিক
এবং সাধারণ ভক্ত এই মন্দিরে দেবতাকে অর্ঘ্য দিয়েছেন। এমনকি, প্রাচীনকাল থেকে যে বিদেশিরা
এসেছেন, তাঁরাও
অর্পণ করেছেন বন্দরনগরীর এই দেবালয়ে। সঞ্চিত সম্পদভাণ্ডার হার মানিয়েছে মানুষের
কল্পনার পরিধিকে।
দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মন্দির কর্তৃপক্ষের জানা
ছিল, মন্দিরে
ছ’টি
গুপ্ত প্রকোষ্ঠ আছে। মন্দিরের পশ্চিম অংশে গর্ভগৃহের কাছে অর্থাৎ মন্দিরের যে
স্থানকে সবচেয়ে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়, যেখানে
দেবতাকে রাখা হয়েছে, তারই
খুব কাছাকাছি রয়েছে এই প্রকোষ্ঠগুলি। সুবিধের জন্য পরবর্তীকালে এদের নাম দেওয়া
হয়েছে ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’, ‘ই’ এবং ‘এফ’। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে
যখন গুপ্তধন গণনার কাজ শুরু হয়, তখন
জানা যায় আরও দু’টি
প্রকোষ্ঠের কথা । তাদের নাম দেওয়া হয় ‘জি’ এবং ‘এইচ’।
প্রকোষ্ঠ বলা হলেও এগুলি আদপে ঘর। যেগুলির মেঝে
থেকে ছাদ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ধনৈশ্বর্যে। অন্য ঘরগুলি খোলা হলেও দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ বা
ভল্ট বি-র দরজা খোলা হয়নি গত কয়েকশো বছর ধরে। মনে করা হয়, এর ভিতরে যা ধনসম্পদ আছে, তা গুনতে গেলে যে কোনও একক-ই
কম পড়তে পারে। পাশাপাশি, ‘জি’ এবং ‘এইচ’ প্রকোষ্ঠও বন্ধ রয়েছে কয়েকশো বছর ধরে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অন্য সমস্ত প্রকোষ্ঠের
সঙ্গে খোলার চেষ্টা করা হয় ভল্ট বি-কেও। ধাতব গ্রিল, কাঠের দরজা খোলা সম্ভব হয়।
তার পরে ছিল একটি লোহার দরজা। সেটা আর খোলা সম্ভব হয়নি। ঠিক হয়, খবর দেওয়া হবে এক জন
কর্মকারকে। কিন্তু তার আগেই সুপ্রিম কোর্ট এই ভল্ট খোলার ব্যাপারে স্থগিতাদেশ জারি
করে। এই প্রকোষ্ঠের ওই লোহার দরজায় ভীষণদর্শন সাপের মূর্তি খোদাই করা আছে। প্রচলিত
বিশ্বাস অনুযায়ী ভিতরের সম্পদ পাহারা দিচ্ছে এক যক্ষী, দরজা খুললে চরম অভিশাপ
অনিবার্য।
‘সি’, ‘ডি’, ‘ই’ এবং ‘এফ’, এই
চারটি প্রকোষ্ঠ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে খোলা হয়। সেখান থেকে ধনসম্পদ এবং প্রয়োজনীয়
জিনিস কাজে লাগানো হয় ধর্মীয় উৎসবে। ২০১১-র ৩০ জুন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খোলা
হয় এর প্রথম প্রকোষ্ঠ অর্থাৎ ভল্ট ‘এ’। সেখানে ঢোকার জন্যেও লোহার এবং কাঠের দু’টি দরজা ভাঙতে হয়। তার পর ঘরে ঢুকে সরাতে হয়
পাথরের ভারী ফলক। দেখা যায়, নীচে
অন্ধকারে নেমে গিয়েছে গুপ্ত সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোঁজ পাওয়া যায় গুপ্তধনের।
সংখ্যায় এক লক্ষের বেশি কোটি কোটি টাকার অমূল্য সম্পদ রাখা ছিল এই গুপ্তকক্ষে।
সব প্রকোষ্ঠে মাটি ও ধাতুর পাত্র, ঝুড়ি ভরে রাখা ছিল
ধনঐশ্বর্য। কী কী ঐশ্বর্য পাওয়া গিয়েছে এই মন্দির থেকে, তার সম্পূর্ণ তালিকা অবশ্য
প্রকাশ্যে আসেনি। বিভিন্ন সূত্র মারফত সংবাদমধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শুধু
ভল্ট ‘ই’ এবং ‘এফ’ থেকে পাওয়া গিয়েছে ৪০ রকমের জিনিস। ‘সি’ এবং ‘ডি’ নামের ঘরে পাওয়া গিয়েছে ৬১৭ রকমের জিনিস।
আর উল্লেখযোগ্য যে জিনিসগুলি ছিল তার মধ্যে অন্যতম হল শ্রীবিষ্ণুর চার ফুট উঁচু
এবং তিন ফুট চওড়া সোনার মূর্তি। সারা বিগ্রহে খোদাই করা আছে অসংখ্য হিরে ও দামী
রত্ন। আর সেই সঙ্গে এই বিগ্রহকে বিশেষ অনুষ্ঠানে পরানোর জন্য আছে সনাতনী পোশাক ‘আঁখি’। সম্পূর্ণ সোনার তৈরি মোট ১৬টি পাল্লার এই
পোশাকের ওজন ৩০ কেজি। দেবতার অঙ্গভূষণ হিসেবে রয়েছে ১৮ ফুট লম্বা সোনার হার। আছে সোনার
তৈরি ধানের ছড়া, যার
ওজন ৫০০ কেজি। সোনার ওড়না আছে, যার
ওজন ৭৬ কেজি। মধ্যযুগের সোনার মুদ্রা আছে ৬০০ কেজি ওজনের।
আরো পাওয়া যায় মোট ১২০০টি সরপ্পলি। দক্ষিণের এই
ঐতিহ্যবাহী সোনার হারে বসানো থাকে দামি পাথর। অসংখ্য বস্তা আছে, যার মধ্যে ছিল মুঠো মুঠো
সোনার জিনিস, নেকলেস, কোমরের বিছে। গয়নায় বসানো
হয়নি এ রকম হিরে, চুনি, পান্না, পোখরাজ এবং অন্যান্য রত্নপাথর
রয়েছে অগণিত। রয়েছে সোনার তৈরি প্রমাণ মাপের সিংহাসনও।
এছাড়া এই মন্দিরে রয়েছে মুদ্রার বিরল ও অমূল্য
ভাণ্ডার। প্রাচীন রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের নেপালিয়নের সমসাময়িক
মুদ্রা সেখানে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের নানা সময়কালের মুদ্রা রাখা আছে
মন্দিরের কোষাগারে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দের সোনার মুদ্রা আছে, যার ওজন প্রায় ৮০০ কেজি।
চের, পাণ্ড্য, পল্লব, চোল-সহ বিভিন্ন রাজবংশ
মূল্যবান অর্ঘ্য দিয়েছে পদ্মনাভস্বামীকে। এ ছাড়া মেসোপটেমিয়া, জেরুজালেম, গ্রিস, রোম এবং পরে ইউরোপের বিভিন্ন
উপনিবেশ থেকে শাসক ও বণিকরা এই মন্দিরে দেবার্ঘ্য দিয়েছেন। কয়েক হাজার বছর ধরে
সঞ্চিত হয়েছে মন্দিরের গুপ্তধন ভাণ্ডার। প্রাচীন ভারতে এই মন্দির পরিচিত ছিল ‘সোনার মন্দির’ হিসেবে।
প্রাচীন মহাকাব্য শিলাপ্পটিকরম-এ বলা হয়েছে
চের-রাজা চেনকুট্টুবান সোনা ও মূল্যবান রত্ন ভেট পাচ্ছেন সোনার মন্দির থেকে। ধরে
নেওয়া হয় এই মন্দির আসলে পদ্মনাভস্বামীর মন্দিরই।
ধনসম্পদ ছাড়াও এই মন্দিরে রয়েছে কিছু কঠোর
নিয়ম। অভারতীয় বা বিদেশিরা মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পান না। এমনকি বিবাহসূত্রে
ভারতীয় হলেও কোনও বিদেশি মন্দিরে ঢুকতে পারেন না। তাছাড়াও শাড়ি পরে মন্দিরে
প্রবেশ করলেও বিদেশিকে হিন্দু হওয়ার শংসাপত্র দেখাতে হয়। এই মন্দিরে প্রবেশ করতে
গেলে মহিলাদের শাড়ি পরতে হয় এবং পুরুষদের ধুতি ও সাদা চাদর গায়ে জড়াতে হয়।এই
পোশাকগুলিকে বলা হয় ভেস্তি এবং অঙ্গবস্ত্র। অবশ্য ২০১৬ সালে সালোয়ার কামিজ পরে
মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি মিললেও মন্দির কর্তা
বা পুরোহিতরা তা বিশেষ পছন্দ করেন না।
আর কেরলের এই পদ্মনাভস্বামী মন্দির থেকে
বিষ্ণুর শোভাযাত্রা বের হবার জন্য তিরুবনন্তপুরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে বছরে
দুবার মোটামুটিভাবে
পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয়। রাজ্যের এই শোভাযাত্রা শতবর্ষের ঐতিহ্য!
আনুমানিক ৫ হাজার বছর ধরে মন্দিরের এই শোভাযাত্রা পালিত হচ্ছে। করোনা অতিমারির
সময়ও এই শোভাযাত্রা বন্ধ রাখা হয়নি। কেরলের এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিতে ধর্মীয়
কারনে বছরে দুবার উড়ান পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়। প্রথমবার হল মার্চ-এপ্রিল মাসে
পেনকুনি উত্সবের জন্য আর দ্বিতীয়বার অক্টোবর-নভেম্বরে আরাত্তু শোভাযাত্রার জন্য। শতাব্দী
প্রাচীন এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য সমস্ত আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বন্ধ
রাখা হয়।
এই শোভাযাত্রায় ভগবান বিষ্ণুকে পালকিতে করে
শ্রী পদ্মানাভস্বামী মন্দির থেকে বিমানবন্দরের ঠিক পিছনেই অবস্থিত শংমুঘাম সৈকতে
নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেবতাকে সমুদ্রে স্নান করানো হয়। বহু শতাব্দী ধরেই এই
মন্দিরের এমন বর্ণাঢ্য ও ঐতিহ্যবাহী যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই পথ দিয়েই
দেবতাকে নিয়ে যাওয়া-আসা করানো হয়। ১৯৩২ সালে এই রুটেই বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
সেই সময় ভগবানকে পালকিতে করে কীভাবে শোভাযাত্রা বের করে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
সেইসময় বলা হয়েথিল, শোভাযাত্রায়
বিমানবন্দরের পথ কখনও বাধা হয়ে থাকবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নিয়মই পালন
করা হচ্ছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন