ভারতে কিভাবে হারিয়ে গেলো আমেরিকার পারমানবিক অস্ত্র?

সালটা ছিল ১৯৬৪। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। আমেরিকা এবং রাশিয়ার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। অন্য দিকে ১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর প্রতিবেশী দেশ চিনকে নিয়ে ভারত তখন বেশ চিন্তিত। ঠিক এই সময় ১৯৬৪ সালে জিনজিয়াং প্রদেশের লপ নূর হ্রদে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে চিন। চিন্তায় পড়ে যায় ভারত এবং আমেরিকা উভয় দেশ। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার সিআইএ এবং ভারতের আইবি যৌথ ভাবে চিনের ওপর নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। দুই সংস্থা মিলে ঠিক করে একটি শক্তিশালী যন্ত্র বসানো হবে ভারত-তিব্বত সীমান্তে। এই যন্ত্রের সাহায্যে চিন থেকে আসা রেডিয়ো সঙ্কেতে নজর রেখে চিনের পারমাণবিক কার্যকলাপের ওপর নজরদারি চালানো যাবে। সিআইএ এবং আইবি-র এই যৌথ উদ্যোগের নাম ছিল ‘অপারেশন হ্যাট’। এই যন্ত্র বসানোর জন্য তিব্বত মালভূমির কাছে এমন একটি জায়গার দরকার ছিল, যেখানকার উচ্চতা অনেক বেশি এবং দৃশ্যমানতায় কোনও বাধা না পড়ে। এর পরেই বেছে নেওয়া হয় ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত নন্দাদেবীকে। যার উচ্চতা ২৫ হাজার ৬৪৩ ফুট বা ৭ হাজার ৮১৫ মিটার।

যন্ত্রটির ওজন ছিল প্রায় ৫৬ কেজি। এত ভারী একটি যন্ত্র নন্দাদেবীর চূড়ায় তোলা তখনকার দিনে সহজ কাজ ছিল না। এতে ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় পরমাণু বোমায় ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের অর্ধেক। যন্ত্রটি বসানোর জন্য লাগত একটি ১০ ফুটের অ্যান্টেনা, দু’টো রেডিয়ো এবং একটি বিশেষ ধরনের জেনারেটর। এই জেনারেটরটি যন্ত্রটিকে চালু রাখার কাজে ব্যবহার করা হত।এই কাজ করার জন্য ১৪ জন পর্বতারোহীর একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়। সকল পর্বতারোহীকে ওই সময় এক হাজার ডলার মাসিক বেতন দেওয়া হয়। ওই দলে ছিলেন আমেরিকার পর্বতারোহী রবার্ট শ্যালার, টম ফ্রস্ট এবং জিম ম্যাকার্থি। ভারতের তরফ থেকে ছিলেন ক্যাপ্টেন এম এস কোহলী, সোনম ওয়াঙ্গাল, এইচ সি এস রাওয়াত এবং জি এস রাঙ্ঘু। এই চার জন ১৯৬৪ সালে ভারতের এভারেস্ট অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন।

ক্যাপ্টেন এম এস কোহলীকে সিআইএ এবং আইবি-র এই যৌথ অভিযানকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়। কোহলী পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তাঁর দলের অভিযাত্রীরা এই অভিযানের ব্যাপারে পুরো জানতেন না। শুধু জানতেন একটি যন্ত্রকে নন্দাদেবীর চূড়ায় তুলতে হবে। ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে সাতটি প্লুটোনিয়ামের ক্যাপসুল এবং কিছু নজরদারি যন্ত্র নিয়ে নন্দাদেবীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অভিযাত্রীর দল। অভিযানের গোপনীয়তা বজায় রাখতে কোনও রকম হেলিকপ্টার বা বিমানের সাহায্য নেওয়া হয়নি।

প্রবল ঠান্ডা এবং ভয়ঙ্কর উচ্চতায় অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, এছাড়া সঙ্গে ৫৬ কেজির ভারী যন্ত্র থাকা। অভিযাত্রীদের কাছে পরিস্থিতি ছিল বেশ প্রতিকূল। ক্যাপ্টেন কোহলী জানান, দলের সুরক্ষাই ছিল তাঁর কাছে প্রধান। চূড়ার কাছে পৌঁছতেই প্রবল হাওয়া এবং তুষারঝড়ের দরুণ আবহাওয়া ক্রমশ প্রতিকূল হতে শুরু করে।পরিস্থিতি বিবেচনা করে পারমাণবিক যন্ত্রটিকে চূড়ার কাছে একটি গুহার মতো জায়গায় রেখে নীচে নেমে আসে অভিযাত্রীর দল। পরের বছর অভিযাত্রীর দল সেই জায়গায় গিয়ে দেখেন, সেখান থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে যন্ত্রটি।এই খবরে চমকে যায় আমেরিকার সিআইএ এবং ভারতের আইবি। এই যন্ত্রে থাকা প্লুটোনিয়াম কোনও ভাবে প্রকৃতিতে মিশে গেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে নন্দাদেবীর নিকটবর্তী জনবসতির। চিন্তায় পড়ে দুই গোয়েন্দা সংস্থা।

এই অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৬৭ সালে নন্দাকোট পর্বতে অনুরূপ একটি যন্ত্র বসায় দুই গোয়েন্দা সংস্থা। এবং নিশ্চিত হয় যে চিনের কাছে কোনও রকম দূরপাল্লার পরমাণু অস্ত্র নেই। ১৯৬৮ সালে হারানো সেই যন্ত্রের খোঁজে দু’টি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার আনানো হয় ভারতে। এই হেলিকপ্টার দু’টি ৩৪ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারত। কিন্তু এতেও কোনও ফল মেলেনি। এর পরেও নন্দাদেবীতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়। কিন্তু যন্ত্রটির কোনও সন্ধান মেলেনি। অনেকে মনে করেন, তুষারধসের কারণে নন্দাদেবীতে হারিয়ে গিয়ে থাকতে পারে পারমাণবিক যন্ত্রটি। কিন্তু সেটিতে থাকা প্লুটোনিয়ামের আয়ু ১০০ বছর। অর্থাৎ আগামী ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত এটি বিপদ তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ যদি নন্দাদেবী থেকে তৈরি হওয়া নদীতে কোনও ভাবে মিশে যায় তবে তা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে। অনেকে মনে করেন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরাখণ্ডের চামোলীতে হড়পা বানের জন্য এই যন্ত্রই দায়ী।নন্দাদেবীতে হিমবাহের ভাঙনের ফলে ঋষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গার জলস্তর আচমকা অনেকটা বেড়ে যায়। আর তার ফলে চামোলীতে হড়পা বানের সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রায় ৮২ জনের মৃত্যু হয়, নিখোঁজ হন ২০০ জন। এই হড়পা বানে ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এনটিপিসির তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হড়পা বানে ক্ষতিগ্রস্ত রেনি গ্রামের বাসিন্দারাও এর জন্য ওই পারমাণবিক যন্ত্রটিকেই দায়ী করে থাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যেখানে হিমবাহের ভাঙন ধরেছিল তার কাছেই ১৯৬৫ সালে হারিয়ে যায় যন্ত্রটি।

১৯৬৫ সালে অভিযানের নেতৃত্বাধীন কোহলী, রেনি গ্রামেই কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি পরবর্তী তিন বছর নন্দাদেবীতে ওই যন্ত্রের খোঁজ চালু রাখেন। ঋষিগঙ্গার জলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ করতে সেই জলও পরীক্ষা করেন। কিন্তু কোনও প্রমাণ মেলেনি।২০১৮ সালে উত্তরাখণ্ডের পর্যটনমন্ত্রী সতপাল মহারাজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী যন্ত্রটিকে খুঁজে বার করার পদক্ষেপে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন।

১৯৭৬ সালে এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্ব রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি ঘোরতর হয় ভারতে। কিছু সময়ের জন্য নন্দাদেবী এবং তার আশপাশের এলাকা সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। যন্ত্রটির খোঁজে সামরিক অভিযান চালানো হয়। বহু বিদেশি পত্রপত্রিকাতেও বিষয়টি নিয়ে লেখা হয়েছিল। ঘরে-বাইরে চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং ব্যাখ্যা করেন কী ভাবে সিআইএ এবং আইবি মিলে এই যৌথ অভিযান চালিয়েছিল।বিপদ জানা সত্ত্বেও এই যন্ত্রটির বর্তমান অবস্থান কিন্তু কারও জানা নেই। যন্ত্রটি যদি এখনও নন্দাদেবীতে থেকে থাকে তবে তা যথেষ্ট বিপজ্জনক বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।