মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৩

এই জঙ্গল হতে সাবধান থাকা উচিত

আত্মহত্যার অরণ্য



আগ্নেয়পর্বত ফুজির উত্তর পশ্চিমে আওকিগাহারা অঞ্চলে সাড়ে
১৩ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জাপানের এই অরণ্য হল
আত্মহত্যার
অরণ্য। যার পোশাকি নাম আওকিগাহারা জুকাই। প্রতি বছর জাপানের
বিভিন্ন অংশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন এই জঙ্গলে
, চিরতরে হারিয়ে যেতে। এখানে গাছ এত বেশি যে, একে বলা হয় গাছের সমুদ্র। কিন্তু সেই ঘন সবুজের
নিঃসঙ্গতাকেই মানুষ বেছে নেয় শেষ শয্যা হিসেবে। দলে দলে মানুষ সেই অরণ্যে আত্মঘাতী
হতে যায়। এই জঙ্গলে সবথেকে বেশি মানুষ আত্মঘাতী হন গলায় ফাঁস লাগিয়ে। তার পরই আছে
অতিরিক্ত পরিমাণে মাদকসেবন। নিয়মিত নজরদারি চালিয়েও বন্ধ করা যায়নি আত্মহত্যা। আগে
জাপান সরকার জানাত প্রতি বছর কতগুলি দেহ এই জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। এখন এই
পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। যাতে জনমানসে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে। এই অরণ্য
এত ঘন যে
, দীর্ঘ দিন মৃতদেহের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ
সময়েই নিথর দেহগুলি শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। আর যেসব মৃতদেহ খোঁজ মেলে সেগুলিকে পুলিশ
এবং স্বেচ্ছাসেবকরা জঙ্গল থেকে উদ্ধার ও শনাক্ত করে তা পরিবারের কাছে পাঠানোর
ব্যবস্থা করে। পরিসংখ্যান বলছে
, প্রতি বছর অন্তত ১০০ মানুষ এই জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেন। এত
কিছুর পরেও এই অরণ্যে মানুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং
, আত্মহত্যার এই ঠিকানায় আবার চলে ক্যাম্পিংও। অনেকে হয়তো ঠিক
করেছেন
, নিজেকে
শেষ করে দেবেন। কিন্তু চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাঁরাও এখানে ক্যাম্প করে
একা একা থাকেন। টহলদার ও নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। বাড়িতে ফেরত
পাঠানোর চেষ্টা করেন।



আত্মহত্যার ধারণা দেশবিশেষে পাল্টে যায়। নিজেকে শেষ করে
দেওয়া কোনও দেশে পাপ
, আবার কোথাও সেই ধারণা কার্যকর নয়। জাপান পড়ে এই দ্বিতীয়
পর্যায়ে। উদীয়মান সূর্যের দেশে যখন সামন্ততন্ত্র ক্ষমতায়
, তখন সামুরাইদের মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই প্রথায় নিজের জীবন শেষ করে দিত পরাজিত সামুরাই। সে সময়
এই প্রথা ছিল গর্বের। এখন এই প্রথা দীর্ঘ দিন অবলুপ্ত। কিন্তু জনমানসে পুরনো
ধারণার রেখা ক্ষীণ হলেও রয়ে গিয়েছে।
অবস্থা পরিবর্তিত হলেও জাপানে আত্মহত্যার হার পৃথিবীতে
সবথেকে বেশি। ২০০৮ সালে পৃথিবী জুড়ে আর্থিক মন্দার সময় জাপানে আত্মঘাতী হয়েছিলেন
২৬৪৫ জন। পরের বছর এই হার বেড়ে যায় ১৫ শতাংশ।এখন প্রশ্ন হল এত মানুষ জাপানে
আত্মঘাতী হন কেন
? মৃত্যুর কারণ হিসেবে
প্রেমে বিচ্ছেদ এবং অন্যান্য পারিবারিক কারণ আছেই। তবে সবথেকে বেশি যে কারণে
জাপানবাসী নিজেকে শেষ করে দেন
, সেটা হল আর্থিক।



কিন্তু কেন এই জঙ্গলকেই মৃত্যুর ঠিকানা হিসেবে বেছে নেওয়া
হয়
? এর পেছনে রয়েছে জাপানের একটি প্রাচীন ইতিহাস। প্রাচীন জাপানে উবসুতে নামে এক প্রথা ছিল। সেখানে
দুর্ভিক্ষের সময়ে পরিবারের বৃদ্ধ অথর্বদের রেখে আসা হত বাড়ি থেকে বহু দূরে প্রত্যন্ত
কোনও নির্জন জায়গায়। সেখানেই তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করে নিতেন তাঁরা। সেই প্রথা
পালনের একটি গন্তব্য ছিল আওকিগাহারা জুকাই। সেই থেকে এই জঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে
গিয়েছে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন