বর্তমান বিশ্বের সবথেকে গরীব এলাকা বলে ধরা হয়
আফ্রিকান মহাদেশীয় অঞ্চলকে। সেই আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে ইদানীং ডলার-বিমুখতা
লক্ষ্য করা গিয়েছে। মহাদেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্যের জন্য তারা আমেরিকান মুদ্রা
ব্যবহারের পক্ষপাতী নয়। আফ্রিকার বাইরে অন্যত্রও ভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারের কথা চলছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুনিয়ায় এবার হয়তো
আমেরিকান ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। অনেক দেশই বাণিজ্যিক
লেনদেনে ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। আফ্রিকার একাধিক দেশ সেই তালিকার নবতম
সংযোজন। ভারতে অবস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাসের তরফে সম্প্রতি ডলারের আধিপত্য
বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ডলার-বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছেন ওই
দেশের প্রতিনিধি।
কিছু দিন আগে ডলারের বিরুদ্ধে বলতে শোনা গিয়েছে
কেনিয়া থেকেও। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো অন্য আফ্রিকান নেতাদের মহাদেশের
অভ্যন্তরে বাণিজ্যের জন্য ডলার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সে
ক্ষেত্রে বিকল্প হিসাবে প্যান-আফ্রিকান লেনদেন ব্যবস্থায় আস্থা রাখার কথা বলেছেন
কেনিয়ান প্রেসিডেন্ট। এই ব্যবস্থা ২০২২ সালে চালু করা হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। এটি
তাদের একটি স্বতন্ত্র বাণিজ্যিক পদ্ধতি।
অবশ্য শুধু আফ্রিকা নয়, দক্ষিণ আমেরিকাতেও সম্প্রতি
ডলার-বিরোধী প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। ‘ডি-ডলারাইজেশন’কে সমর্থন করেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশ। ‘ডি-ডলারাইজ়েশন’ এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আমেরিকার
মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সিংহাসন থেকে সরিয়ে তার গুরুত্ব বা মান কমিয়ে আনা
যায়। এই প্রক্রিয়ায় সামিল হতে আগ্রহী অনেক দেশই।
চলতি বছরের এপ্রিলে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস
ইনাসিয়ো লুলা দ্য সিলভা চিন সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি বিভিন্ন দেশকে ডলার
বর্জন করে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের ডাক দিয়েছেন। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ডলার না ব্যবহার করার
চুক্তি হয়েছে ব্রাজিল এবং চিনের মধ্যে। তার পরেই ডলার ত্যাগের কথা অন্য দেশগুলিকেও
বলেছেন ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট। ডলারের বিরোধী হতে দেখা গিয়েছে আর এক দক্ষিণ আমেরিকান
দেশ আর্জেন্টিনাকেও। তারা সম্প্রতি চিনের সঙ্গে বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে চিনা
মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে সম্মত হয়েছে।
জ়িম্বাবোয়েতে গত বছর চূড়ান্ত অর্থনৈতিক
সঙ্কটের মাঝে ডলারের বিকল্প সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই দেশে সোনার মুদ্রা চালু
করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ডলারের চেয়ে জ়িম্বাবোয়ের মুদ্রার মান এক ধাক্কায়
অনেকটা পড়ে গিয়েছিল। যার ফলে দেশে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। দ্রুত
বেড়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে জ়িম্বাবোয়ে
ডলারের বিকল্প হিসাবে নিয়ে আসে সোনার মুদ্রা। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াইয়ে তা কাজে
লাগতে পারে, বলে
মনে করা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও জ়িম্বাবোয়ের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত
জানিয়েছেন।
‘ডি-ডলারাইজেশনে’ পিছিয়ে নেই ভারতও। বিশ্বের মোট ১৮টি দেশে
‘স্পেশাল
রুপি ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট’
বা এসআরভিএ খোলায় সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)।এই দেশগুলি
নিজ নিজ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারে আগ্রহ হারিয়েছে। ডলারের বিকল্প
হিসাবে তারা ভারতীয় টাকায় উৎসাহ প্রকাশ করেছে। সুতরাং রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, বোৎসোয়ানা, জার্মানি, ব্রিটেন, ফিজি, গায়ানা, ইজ়রায়েল, কেনিয়ার মতো দেশ ভারতের সঙ্গে
ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য করবে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার
পাণ্ডে অবশ্য ডি-ডলারাইজেশনের এই ধারণাকে নতুন বলতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে অতীতেও ভারত
রুবেলে অর্থাৎরাশিয়ান মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা-সহ
পশ্চিমের দেশগুলি পুতিনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ফলে রাশিয়ার
সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য হোঁচট খায়।তার পর থেকে ভারত এবং রাশিয়া পারস্পরিক
বাণিজ্য করে থাকে রুবেল এবং ভারতীয় টাকার সাহায্যে। তবে চলতি বছরের মার্চ মাসে
রাশিয়ার কিছু আপত্তিতে সেই ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয়
ব্যাঙ্কগুলিতে যে ডলারের শেয়ার ছিল ৭১ শতাংশ, তা
বর্তমানে কমে এসেছে ৫৯ শতাংশে। ডলারের শেয়ার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ইউরো এবং চিনা
ইউয়ানের শেয়ার বৃদ্ধি।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, আমেরিকা বরাবর তাদের ডলারকে
অন্য দেশগুলিকে দমিয়ে রাখবার অস্ত্র হিসাবে দেখে এসেছে। এই পন্থাই ডলারের পতনের
সূচনা করেছে। আগামী দিনে ডলারের মূল্য এবং গুরুত্ব যত কমবে, তত অন্যদের আত্মবিশ্বাস
বৃদ্ধি পাবে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন