১৮৯৩ সালে হায়দরাবাদের ঠিক মাঝখানে ধীরে ধীরে
একটি রাজপ্রাসাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। গগন চুম্বী এই প্রাসাদের নাম ফলকনামা
প্রাসাদ। আসলে ফলকনামা শব্দের অর্থ আকাশের মতো। নবাব বিকার-উল-উমরা ১৮৯৩ সালে এই
প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। নবাব যখন ইউরোপে ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার
রাজপ্রাসাদগুলির আদলে ভারতেও অমন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।তারপর তিনি
দেশে ফিরে হায়দরাবাদ শহরের ঠিক মাঝখানে নির্মাণ করে ফেলেন ফলকনামা প্রাসাদ।
সৌন্দর্যের দিক থেকে এই প্রাসাদ তাকলাগানো।
৩২ একর জমির উপর বানানো ফলকনামা প্রাসাদ নিজের
শখে তৈরি করেছিলেন নবাব বিকার-উল-উমরা। সেই সময় ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে এই প্রাসাদ
নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তখনকার দিনে ৪০ লক্ষ টাকা মানে বর্তমানে কত কোটি টাকার
সমান, তা
কল্পনাতীত। ফলকনামা প্রাসাদ তৈরি করার পর দেউলিয়া হয়ে যান নবাব বিকার-উল-উমরা।
হায়দরাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মির মেহবুব আলি খান যখন এই প্রাসাদে সময় কাটাতে আসেন তখন
প্রাসাদের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। নবাবকে আর্থিক সাহায্যের হাতও
বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজাম।
অধিকাংশ মানুষের অবশ্য দাবি, ফলকনামা প্রাসাদ ভারতের
পুরানো সংসদ ভবনের চেয়েও প্রায় পাঁচ গুণ বড়। বৃশ্চিক অর্থাৎ বিচ্ছুর আকারে তৈরি এই
প্রাসাদ এক সময় অতিথিনিবাস হিসাবেও ব্যবহৃত হত। তবে, কারুকার্য এবং নির্মাণের দিক
থেকে যতই নজরকাড়া হোক না কেন, ফলকনামা
প্রাসাদের মূল আকর্ষণ কিন্তু ভিন্ন। এই প্রাসাদের অন্দরমহলে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে
লম্বা ডাইনিং টেবিল।
এই ডাইনিং টেবিলটি কারুকার্যের দিক থেকে যেমন
অনন্য, ঠিক
তেমনই তার আকারের জন্যও বিশ্বজোড়া নজির গড়েছে ফলকনামা প্রাসাদ। ফলকনামা
প্রাসাদের অন্দরে থাকা এই ডাইনিং টেবিলটি ৮০ ফুট লম্বা। টেবিলটি মোট সাতটি টুকরোয়
বিভক্ত। একসঙ্গে এই টেবিলে মোট ১০১ জন অতিথি বসে খেতে পারেন। প্রাসাদের নির্মাণের সময় নাকি রাজপরিবারের
সদস্যদের একসঙ্গে বসে খাওয়ার নিয়ম ছিল।একসঙ্গে এতজন টেবিলে বসলে কথা বলার অসুবিধা
হতে পারে।সেই সমস্যা সমাধানের জন্য এই টেবিলে বসার ব্যবস্থা এমন ভাবে করা হয়েছে যে, টেবিলের যে কোনও প্রান্তে বসে
নিচু স্বরে কথা বললেও তা দূর প্রান্তের আসনে বসা ব্যক্তি শুনতে পাবেন।
এই টেবিলের উপরে দেওয়াল থেকে ঝুলতে দেখা যায়
নবাবি নকশা করা ঝাড়বাতি। ডাইনিং রুমের দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্র আঁকা রয়েছে। সেই
চিত্রগুলি যথেষ্ট অর্থবহ এবং খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত।দেওয়ালের গায়ে আঁকা ওই
চিত্রগুলি আসলে এক একটি খাবারের ছবি। অর্থাৎ সারা ঘর জুড়ে এক একটি খাবারের চিত্র
দিয়ে দেওয়ালের মধ্যেই অভিনব তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, নবাবরা যখন খেতে বসতেন, তখন দেওয়ালের ওই আঁকাগুলির
দিকে আঙুল দেখাতেন। অঙ্গুলিনির্দেশ করা চিত্র অনুযায়ী নবাবকে সেই খাবার পরিবেশন
করা হত।
এছাড়া ফলকনামা প্রাসাদের ডাইনিং রুমে মানব
পরিচালিত পাইপ অরগ্যান রয়েছে। ইতিহাসবিদেরা জানিয়েছেন যে, সারা বিশ্বে মানব পরিচালিত
পাইপ অরগ্যান মাত্র দু’টি
রয়েছে। তার মধ্যে একটি রয়েছে ফলকনামা প্রাসাদের অন্দরমহলে।
শুধু দীর্ঘতম ডাইনিং টেবিলই নয়, অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য
ফলকনামা প্রাসাদের ভিতর রয়েছে একটি বিশাল গ্রন্থাগার। নবাব বিকার-উল-উমরা যখন
ইউরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তখন
উইন্ডসর প্রাসাদের গ্রন্থাগারটি দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি
ফলকনামা প্রাসাদে অনুরূপ একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন। এই গ্রন্থাগারে প্রায় ৬
হাজার বই রাখা রয়েছে। শোনা যায়, ১৮০১
সালে প্রকাশিত বহু বইও রয়েছে এখানে। যে নবাবেরা এই প্রাসাদে ঘুরতে এসেছিলেন, তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতাও
কাগজেকলমে লিখে রেখে গিয়েছিলেন। সেই প্রাচীন নথিও সংগ্রহ করা রয়েছে গ্রন্থাগারের
ভিতর।
আবার এই গ্রন্থাগারের কাছেই একটি ঘরে রয়েছে বিলিয়ার্ড
খেলার বন্দোবস্ত। নবাব বিকার-উল-উমরা যখন বাকিংহাংম প্রাসাদে ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন
বিশালাকার বিলিয়ার্ড টেবিল দেখেছিলেন। তারই অনুপ্রেরণায় তিনি ফলকনামা প্রাসাদের
ভিতরেও হুবহু বাকিংহাম প্রাসাদের মতোই বিলিয়ার্ড খেলার বন্দোবস্ত করেন।
২০০০ সালে তাজ হোটেল এই প্রাসাদের সংস্কার এবং
পুনরূদ্ধার কার্য শুরু করে। সংস্কার করা প্রাসাদটি হোটেল হিসাবে অথিতিদের জন্য
২০১০ সালে নভেম্বর মাসে খুলে দেওয়া হয়।
বর্তমানে তাজ হোটেল গ্রুপের কাছে এই হোটেলের পঞ্চাশ বছরের লিস নেওয়া রয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন